দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা জাত খাদ্য ও চিকিৎসা

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা :  দেশি মুরগি পালন করা অনেক লাভজনক ব্যবসা আজকে আমরা আপনাদের দেশি

মুরগি পালন করা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দিব। দেশি মুরগী পালনের বিষয়ে আপনার আর কোন বিষয়ই অজানা থাকবেনা।

মুরগীর ঘর ব্যবস্থাপনা, খাবার ব্যবস্থাপনা, মুরগির চিকিৎসা সহ কোন ধরনের মুরগি মাংসের জন্য পালন করবেন এবং

কোন ধরনের মুরগি  ডিমের জন্য পালন করবেন।  বর্তমানে দেশে   অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে দেশি মুরগি পালন করা হচ্ছে

লাভজনক ব্যবসা। আমরা সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের সমাজের যে সকল বেকার নারী-পুরুষ ও বাড়ির গৃহিণী, আছে

তারা অল্প পুঁজি নিয়ে দেশি মুরগি পালন শুরু করতে পারি। আর যদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকে তাহলে আমাদের এই

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা লেখা পড়ে আপনার  দেশী মুরগী পালন শুরু করতে পারবেন। আর দেশি মুরগির ডিম ও

মাংসের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া  আপনারা সকলেই জানেন দেশি মুরগির রোগ বালাই কম। আর অল্প যে

টুকু  আছে সেগুলো ভ্যাকসিন দিয়ে রাখলে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।  দেশি মুরগির ডিম ও মাংসের প্রচুর পুষ্টি রয়েছে। চলুন

কিভাবে দেশি মুরগি পালন করতে হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা করি।

সূচিপত্র

মুরগির জাত পরিচিতি / দেশি মুরগির জাত

বাংলাদেশে সাধারণত তিনটি জাতের মুরগি দেখা যায়। তাছাড়া সংকর জাতের মুরগিও দেখা যায় । দেশি জাতের মুরগি গুলোর মধ্যে হল-

  1. কমন দেশি জাত।
  2. গলাছিলা।
  3. হিলি জাত ।

এছাড়াও বিদেশি জাতের মধ্যে হল  সোনালী ও টাইগার অন্যতম।

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এর মুরগী পালন পদ্ধতি

দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাছাড়া দেশি মুরগীর ডিম ও মাংসের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধির  ফলে, বর্তমানে

দেশের তরুণ তরুণী ও গৃহিণীগন এ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। দেশি মুরগি আগে শুধু মুক্ত অবস্থায় পালন করা হতো কিন্তু

বর্তমানে খোলা অবস্থায়, ঘরে, খাচাঁয় ও ঘরের ছাদে বেড়া তৈরী করে  দেশি মুরগি পালন করা হয়। দেশি মুরগি আবদ্ধ

অবস্থায় পালন করলে রোগ বালাই কম হয়  এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয় এতে উৎপাদন বৃদ্ধি হয়। তাই আমরা যদি

বানিজ্যিক ভাবে দেশি মুরগী পালনের কথা চিন্তা করি তাহলে আবদ্ধ অবস্থায় পালন করলে অধিক লাভ হবে।

আধুনিক পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদন- Modern way Chicken Production

আধুনিক পদ্ধতিতে বাচ্চা  ফুটানোর ইনকিউবেটর ব্যবহার করে  আমরা খুব সহজে অনেকগুলো বাচ্চা ফুটাতে পারি এখন

২০টি থেকে  শুরু করে অনেক বেশি পর্যন্ত ডিমের বাচ্চা ফোটানোর  ইনকিউবেটর পাওয়া যায়।  এই পদ্ধতি আমরা একই

সময়ে বেশি বাচ্চা উৎপাদন করতে পারি । যা আমাদের  সময় এবং শ্রমের সাশ্রয় হয়।

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এর সনাতন পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদন

এই পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদন খুব সহজ । এখনো গ্রাম অঞ্চলে এই পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানো হয় । এই পদ্ধতিতে বাচ্চা

ফোটানোর নিয়ম আমি ধাপে ধাপে আপনাদের বলে দিচ্ছি

ধাপ ০১:  আপনি প্রথমে ১২ থেকে ১৬টি  জাত ডিম নিবেন।

  ,, ০২: কিছু চুলার ছাই  নিবেন এবং  চুলার ছাইয়ের সাথে ৩ থেকে ৪ দানা নেপথলিন মিশিয়ে নিবেন।

   ,,  ০৩:নেপথলিন মিশানো ছাই প্রথমে দিয়ে তার উপর কিছু ধানের তুষ দিবেন,

    ,,  ০৪:  ধানের তুষের উপর কিছু ধানের খড় দিবেন বিছিয়ে তার উপরে ডিমগুলো সুন্দর করে বিছিয়ে দিয়ে দিতে হবে।

মুরগির যে পাত্রে বসাবেন তার সাথে একটি পানির পাত্র এবং একটি খাবারের পাত্র রাখবেন। যাতে করে মুরগির ঘন ঘন

খাবার বা পানির জন্য বাইরে না যেতে হয়। তাহলে দেখবেন আপনার ডিমগুলো  খুব সুন্দর ভাবে ফুটবে এভাবেই দেশীয়

পদ্ধতিতে সহজে মুরগির বাচ্চা ফুটাতে পারবেন।

এছাড়াও আমাদের চ্যানেলে দেশি মুরগির ডিম ফুটানোর ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে আপনি ইচ্ছে করলে দেখে আসতে পারেন।

(দেশি মুরগির ডিম ফুটানো ব্যবস্তাপনা ইউটিউব)

এছাড়াও আপনি যদি দেশি মুরগির বাচ্চা ফুটার পর কিভাবে বাচ্চার পরিচর্যা করতে হয় দেখতে চান তাহলে দেখতে পারেন আমাদের আরেকটি ভিডিও।

(দেশি মুরগীর বাচ্চার পরিচর্যা ইউটিউব)

দেশি মুরগির ঘর ব্যবস্থাপনা- Chicken House Management

মুরগির ঘর নির্মাণে  খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খেয়াল রাখতে হবে যেন সেখানে আলো-বাতাসের চলাচল থাকে। মুরগির ঘর

যেন অত্যাধিক গরম বা শীত না হয়। মুরগির ঘরের কাছাকাছি খাবার ও পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। মুরগি যাতে কোনো

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মুরগির শত্রু যেমন কুকুর বিড়াল বেজি দ্ধারা যেন

আক্রমণ নাহতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে ঘরের বেড়া মজবুত করতে হবে।

মাংস উৎপাদনকারী মুরগির জাত কোনটি

আমরা যদি মাংস উৎপাদনের জন্য দেশি প্রজাতির জাত নির্বাচন চিন্তা করি তাহলে তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো যাচ্ছে হিলি

জাতের মুরগি ।এই মুরগী পালন করলে আমাদের বেশি লাভ হবে । এ জাতের মুরগির ওজন ১.৫  থেকে ২কেজি এবং

মোরগের  ওজন ২ থেকে ৩.৫ কেজি পর্যন্ত হয়। এই মুরগি সাধারণত চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা যায়। এদের আকার

অনেক বড় হয় বলে মাংসের পরিমাণ অনেক বেশি হয়  আর তাই আমরা যারা মাংস উৎপাদনের জন্য মুরগি পালন করবো

তাদের জন্য ’’হিলি জাতের মুরগি’’ হচ্ছে উত্তম।

মাংসের মুরগির খাবার ব্যবস্থাপনা-Food Management for Meat Chicken

দেশি মুরগি আধুনিক প্রযুক্তিতে পালন করলে আমাদের অবশ্যই ভালো মানের খাবার খাওয়াতে হবে । যাতে মাংস ও  ডিম

উৎপাদনে কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে । আর আমরা যদি ব্রয়লার  মুরগির খাবার কিনে খাওয়াই  সে ক্ষেত্রে খরচ বেশি

হবে। আসুন আমরা জেনে নেই কিভাবে ভালো মানের খাবার কম দামে বানানো যায়।

ধরুন আজকে আমরা ১০০ কেজি খাবার তৈরি করব আপনি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার বানাবেন। সে ক্ষেত্রে শুধু উপকরণগুলো কম বা বেশি করে নিয়ে নিবেন।

  1. ভুট্টা ভাঙ্গা                                        ৩৫ কেজি
  2. সয়াবিন                                           ৩০ কেজি
  3. রাইস পলিশ                                    ২৫ কেজি
  4. ফিশমিল                                            8 কেজি
  5. ডিসিপি পাউডার                                 ১ কেজি
  6. লবণ                                                   ১ কেজি
  7. ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স                 ১৫০ গ্রাম

উপরের সবগুলো উপাদান ভালো করে একসঙ্গে মিশিয়ে রোদ্রে শুকিয়ে  বস্তায় বা ড্রামে সংরক্ষণ করতে হবে । যাতে করে পরবর্তীতে আমরা আস্তে আস্তে খাওয়াতে পারি।

ডিম উৎপাদনকারী মুরগির জাত

বাংলাদেশ দেশি জাতের মুরগির মধ্যে গলাছিলা জাতের মুরগি সবচেয়ে ডিম পাড়ার জন্য উপযোগী। কারণ এ জাতের

মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি এবং বছরে তারা ৯০ থেকে ১২০ টি  ডিম দিয়ে থাকেগলাছিলা জাতের

মুরগি ডিম পাড়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী জাতের মুরগি । এজাতের মুরগি চেনার উপায়- এই মুরগির গলায় কোন পালক

থাকেনা, চামড়ার রঙ হলুদ বা লাল রং হয়। অন্য মুরগির তুলনায় মুরগি আগে ডিম পাড়ে এবং মুরগি বাচ্চা ফুটানোর জন্য

ওমে বসালে  ডিম ভালো তা দিতে পারে।

মুরগীর খাবার তৈরী

ডিম পাড়া মুরগির খাবার তৈরীর সময় আমাদেরকে ডিম পারার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। যে সকল খাবার খাওয়ালে

ডিমের পরিমান বেশি দিবে সেই ধরনের খাবার খাওয়াতে হবে।  ধরুন আজকে আমরা ১০০ কেজি খাবার তৈরি করব তার

মধ্যে যে সমস্ত উপকরণ লাগবে তা নিম্নে দেয়া হল-

  • গম /চালের খুত/ ভুট্টা ভাঙ্গা                        ৪০ কেজি
  • সয়াবিন মিল                                                  ২৫ কেজি
  • ফিস মিল                                                          ৭ কেজি
  • চালের কুড়া                                                   ২৫ কেজি
  • ঝিনুকের গুড়া                                                  ৩ কেজি
  • লবণ                                                                  ১কেজি
  • মিনারেল প্রিমিক্স                                             ১৫০ গ্রাম

উপরের উপাদান গুলো ভালভাবে মিশিয়ে রোদ্রে শুকিয়ে বস্তায় বা ড্রামে সংরক্ষণ করতে হবে সেগুলো যেন নষ্ট না হয়

পরবর্তীতে আস্তে আস্তে খাওয়াতে হবে।

দেশী মুরগী পালন ও চিকিৎসা

দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। তবে অল্প কিছু রোগের টিকা দিতে পারলে দেশি মুরগির রোগ নিয়ন্ত্রণে

রাখা যায়। দেশি মুরগি সাধারণত যেসব রোগ হয় সেগুলো হলো।

  1. মুরগির রানীক্ষেতে রোগ।
  2.   ..        গামবোরো রোগ।
  3.    ,,       কলেরা রোগ।
  4.   ,,         বসন্ত বা পক্স।

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এর মুরগির রানীক্ষেত রোগ

রানীক্ষেত রোগ হলে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে মুরগি আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই রোগ আক্রান্ত হলে ১০০

ভাগ পর্যন্ত মুরগির  মৃত্যু ঘটতে পারে। রানীক্ষেত রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ রোগ হতে সচেতন থাকতে হয়। আর

যদি মুরগির  রানীক্ষেত রোগ হয়ে যায় তাহলে আর কিছুই করার থাকে না। কারণ এই রোগের এখনো চিকিৎসা নেই। তবে

ভ্যাকসিন দিয়ে রাখলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

(রানীক্ষেত রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত)

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এর মুরগির গামবোরো রোগ

গামবোরো হল একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এ রোগের সংক্রমণ হার অনেক বেশি। তবে মৃত্যুর হার৩০ শতাংশ। এ রোগ

হলে খাদ্যর রুচি কমে যায়।  শরীরের  তাপমাত্রা বেড়ে যায়। পায়খানা পাতলা ও সাদা চুনের মত হয়। মলদ্বার ভেজা দেখা

যায়। মুরগির কাটলে কলিজা বড় ও ফ্যাকাশে দেখায়। এই রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ভ্যাকসিন দিয়ে

রাখলে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এর মুরগির কলেরা রোগ

কলেরা হল এক ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ । খাবার ও পানি থেকে এই রোগ হয়। এই রোগ দুই মাসের বেশি বয়সের হাঁস-

মুরগির ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই রোগ হলে মুরগির পায়খানা সবুজ ও পাতলা হয়ে যায়। মুরগির শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় আস্তে

আস্তে মুরগি দুর্বল হয়ে পড়ে। মুরগির  ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়াও  মুরগির হাটু ও মাথা ফুলে যায় এবং মাথার

ঝুটি কালো হয়ে যায়। এই রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রেনামাইসিন খাওয়াতে হবে । সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে মুরগি

ভাল হয়ে যায়।

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এর মুরগির বসন্ত বা পক্স

মুরগির বসন্ত বা পক্স ভাইরাসজনিত রোগ। এ রোগ যদি মুরগির বাচ্চার হয় তাহলে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। সাধারণত

এদের যেখানে পালক নেই সেখানে গুটি তৈরি হয় এবং পরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। চোখে পক্স উঠলে চোখ বন্ধ হয়ে যায় মুরগির

ওজন দ্রুত কমে যায়। যদি মারাত্মক ভাবে আক্রমণ করে তাহলে খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী তে সাদা হলুদ রঙের ঘা দেখা যায়।

যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ তেমন কোনো চিকিৎসা নেই তবে পটাশ ও নারকেল তেল মিশিয়ে দিনে ৩ থেকে ৪ দিন

লাগিয়ে  দিলে উপকার হবে । অথবা আপনারা যদি ফিটকিরি পানিতে তুলা দিয়ে বার বার মুছে দেন তাহলে উপকার হবে।

দেশি মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এর শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি আপনার যদি মুরগি পালন সম্পর্কে আরো কোন বিষয়ে জানার ইচ্ছে থাকে তাহলে আমাদের

কমেন্ট বক্সে লেখতে পারেন ।  আমাদের অন্য লেখায় মুরগির রোগ বালাই সম্পর্কে আমাদের যে বিস্তারিত আলোচনা আছে

সেখান থেকে দেখে আসতে পারেন। তাহলে মুরগি পালন সম্পর্কে আপনি পরিপূর্ণ একটি ধারণা পাবেন এবং এ ধারনা

থেকে আপনি বাড়িতে ছোট কিংবা বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালন করা শুরু করে দিতে পারবেন। ধন্যবাদ সবাইকে কষ্ট

করে আমার এই লেখাটি পড়ার জন্য।

একই জাতীয় অন্যান্য বিষয় পড়তে পারেন

About 24 Favor

Check Also

Meeting minutes writing format

Meeting minutes writing format: Who has engaged with NGO job maximum people need writings this …